সেলফ ইম্পুভমেন্ট এর জন্য কাইজেন (Kaizen) নামক বিশ্ববিখ্যাত জাপানিজ দর্শন আছে ।যার মুল কথা হল আপনাকে কন্টিনিয়াস ইম্পুভমেন্ট করতে হবে। গুগল, ফেসবুকের দিকে তাকালেই দেখবেন তাদের ফিচার গুলো কন্টিনিয়াস ইম্পুভমেন্ট করা হয়। এজন্যই কিন্তু তারা মার্কেট ধরেআছে। অপরপক্ষে কোডাক (Kodak) কিংবা এভিরেডী (Eveready ) কোম্পানিগুলো কিন্তু বিলুপ্ত হয়ে গেছে সময়ের সাথে নিজেদের উন্নত না করার কারনে।
তাই প্রিয় পাঠক, আমাদের কিন্তু জানার ক্ষেত্রে কমতি করা যাবে না। নিজেদের কন্টিনিয়াসলি ইম্পুভমেন্ট করতে হবে। এক্ষেত্রে মাতৃভাষায় নলেজ শেয়ারিং প্লাটফর্ম হিসেবে বুনন সহজভাবে টেক্সটাইল শেখা ও জানার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
যার ধারাবাহিকতায় আজ আপনাদের নতুন এক টেকনোলজির সাথে পরিচয় করিয়ে দেব ও জানব আমাদের টেক্সটাইল সেক্টরে ইহা কোথায় কোথায় কাজে লাগছে। তো চলুন প্রিয় পাঠক আজ জেনে আসি “ইলেক্টোস্পিনিং টেকনোলজি” সম্পর্কে।
ইলেক্টো স্পিনিং টেকনোলজি: বৈদ্যুতিক উচ্চ ভোল্টেজ এর সাহায্যে ক্ষুদ্র নজেল এর মধ্য দিয়ে সলুশন বের করে ন্যনোমিটার ব্যসের ফাইবার তৈরি করার টেকনোলজিই আমাদের কাছে ইলেক্টো স্পিনিংটেকনোলজি নামে প্রচলিত। যা একটি সাধারন প্রযুক্তি মনে হলেও প্রিয় পাঠক এর বিস্তর ব্যবহারের কথা শুনলে আপনি অবাক হবেন। বায়োমেডিকেল, এনার্জি স্টোরেজ, এনার্জি উৎপাদন, ক্ষত ড্রেসিং, ড্রাগ ডেলিভারী, টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিফেন্স পোশাক, প্রোটেকটিভ ক্লদিং সহ বিজ্ঞানের বিভিন্ন সেক্টরে ইলেক্টো স্পান পদ্ধতির ন্যনো ফাইবারের ব্যবহার লক্ষনীয়।
মেকানিজম: এই পদ্ধতিতে মেশিনের ফিড জোনে প্রস্তুতকৃত লিকুইড দেয়া হয়। যখন ড্রপলেটে পর্যাপ্ত উচ্চ ভোল্টেজ প্রয়োগ করা হয় তখন লিকুইড চার্জিত হয়ে যায়, এবং তড়িৎস্তর প্রতিরোধের সারফেস টেনশনকে মোকাবেলা করে এবং ড্রপলেট প্রসারিত হয়; একটি ক্রিটিকাল পর্যায়ে, তরল একটি স্রোত পৃষ্ঠ থেকে প্রস্ফুটিত হয়। এই অগ্ন্যুত্পাতটি টেলর কোণ হিসাবে পরিচিত। যদি তরলের আণবিক কোহেসন পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে তবে স্ট্রিম ব্রেকআপ ঘটে না (যদি তা হয় তবে, ফোঁটাগুলি ইলেক্ট্রোস্প্রে হয়) এবং একটি চার্জযুক্ত তরল জেট গঠিত হয়। জেটটি যখন ফ্লাইটে শুকিয়ে যায়, চার্জটি ফাইবারের পৃষ্ঠের দিকে চলে যাওয়ার সাথে সাথে বর্তমান প্রবাহের মোডটি ওমিক থেকে কনভেটিভে পরিবর্তিত হয়। জেটটি ততক্ষণে ফাইবারের ছোট ছোট মোড়গুলিতে ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক বিকর্ষণজনিত একটি চাবুক প্রক্রিয়া দ্বারা দীর্ঘায়িত হয় যতক্ষণ না অবশেষে গ্রাউন্ডেড কালেক্টারে জমা হয় [ এই বাঁকানো অস্থিতিশীলতার ফলে ফাইবারের প্রসার ও পাতলাকরণ ন্যানোমিটার-স্কেল ব্যাসের সাথে অভিন্ন তন্তুগুলির গঠনের দিকে পরিচালিত করে। আর এভাবেই তৈরি হয় ন্যনোমিটার আকারের কন্টিনিয়াস ফাইবার ম্যাট।

ইলেক্টোস্পান ন্যানো ফাইবারের ব্যবহার:
প্রোটেকটিভ ক্লদিং: ন্যানো ফাইবার ম্যাটগুলির পারমিয়াবিলিটি এবং এই ন্যনো ম্যাটের মধ্য দিয়ে শ্বাস প্রশ্বাস নেবার ক্ষমতা আছে। প্রয়োজনীয় বাধা বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে উচ্চ শ্বাস-প্রশ্বাস বা জলীয় বাষ্প সংক্রমণ হার (ডাব্লুভিটিআর) বহন করার দক্ষতার কারণে ন্যানোফাইবার মেম্ব্রেন প্রোটেকটিভ ক্লোদিং যেমনঃ পি পি ই তে ব্যবহৃত হয়।
এনার্জি স্টোরেজ এবং এনার্জি উৎপাদনে: এনার্জির অপরিকল্পিত ব্যবহারের কারনে আমাদের পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ ,গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর ফলে আমাদের উপর নেমে আসছে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। যার ফলে এমন সব ডিভাইস ডেভেলপ করা সময়ের দাবি ছিল যা কার্যকর ভাবে এনার্জি সংরক্ষন ও উৎপাদন করতে পারে। এরকম ডিভাইস যেমন- সোলার সেল, ফুয়েল সেল, ইলেক্টোকেমিক্যাল হাইড্রোজেন উৎপাদন, ব্যটারী, সুপার ক্যপাসিটর সহ ইত্যাদি ডিভাইসের ইলেক্টোড ও মেমব্রেন উৎপাদনে ইলেক্টো স্পান ম্যাট ব্যবহার হয়েছে যা সত্যিই অসাধারণ।

পানি পরিশোধনেঃ আমাদের ওয়েট প্রসেস ইন্ডাস্টী পানি দূষণের জন্য অনেকাংশে দায়ী। ইটিপি প্লানের নতুন এক যুগের সুচনা করতে পারে এই ইলেক্টোস্পান মেমব্রেন।

ক্ষত ড্রেসিংঃ অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ন্যনো মেমব্রেন ক্ষত স্থানের চিকিৎসার জন্য বহুল ব্যবহৃত হচ্ছে। আমরা যদি আমাদেরকে মেডিকেল টেক্সটাইলের পণ্য রপ্তানির অন্যতম জায়ান্ট হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করাতে চাই তবে এই ইলেক্টো স্পান ম্যাট সেক্ষেত্রে অবদান রাখতে সক্ষম।

টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং: ন্যানো ফাইবার উচ্চ পোরাসিটি, সফট ফিলিংস সহ ইত্যাদি গুনাবলি থাকার কারনে ইহা টিস্যু ইঞ্জিনিয়ারিং এ ব্যবহার হচ্ছে।
ইলেক্টো স্পিনিং টেকনোলজি ও বাংলাদেশ:
আপনারা ইতিমধ্যে এই ইলেক্টো স্পিনিংটেকনোলজি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেয়েছেন। আমার জানা মতে,বাংংলাদেশ এই মেশিন বাল্প স্কেলে আসেনি। ল্যাব স্কেলের মেশিন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট), গাজীপুরে রয়েছে। এই মেশিন ব্যবহার করে গবেষক দল নতুন কয়েক ধরণের ন্যনো ফাইবার ম্যাট তৈরি করেছেন।যার ফলাফল Elsevier, springer, SAGE ইত্যাদি আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
পরিশেষে একটা গুরুত্বপূর্ন মতামত শেয়ার করে শেষ করব, আপনারা জানেন-কম্ফোর্ট জোনে থাকতে চাওয়া মানুষের একটি সহজাত বৈশিষ্ট । মানুষ সাধারণত ঝুঁকি নিতে,নতুন কিছু করতে বা ব্যতিক্রম কিছু চিন্তা করতে চায় না। দেখুন না, তা না হলে যে টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্প যা দেশের মোট রপ্তানির ৮৬% অর্জনের উৎস তা এমন পরনির্ভর হিসেবে এতটা বছর থাকতে পারে। আমরা আসলে মন থেকে কোনদিন চাইনি আমাদের ব্যকওয়ার্ড লিঙ্কেজ মজবুত হোক, বিদেশীরা টেকনোলজিস্ট দের উপর নির্ভরশীলতা কমুক ইত্যাদি ইত্যাদি। ঐ যে বললাম কম্ফোর্ট জোনে থাকতে চেয়েছি। যেভাবে চলছে চলুক না কি দরকার স্বনির্ভর হওয়ার? করোনা ভাইরাসের হাজারটা ক্ষতিকর দিকের কথা আপনি বললেও আমি বলব- এই মহামারি আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে একটা দেশের ইন্ডাস্টির স্বনির্ভর হওয়ার, ব্যকওয়ার্ড লিঙ্কেজ মজবুত করার,দেশীয় প্রযুক্তির ব্যবহারের এবং গবেষণার গুরুত্ব কতখানি। তাই এখন সময় এসেছে বিষয়গুলো উপলদ্ধি করে উন্নতির পথে এগিয়ে যাওয়ার এবং প্রানের সেক্টরকে এগিয়ে নেবার।
Writer- Tanvir Hossain DUET Research Assistant, Bunon