মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম চাহিদা হলো বস্ত্র। আদিমকাল থেকে মানুষ নিজের লজ্জাস্থান ঢাকার জন্যই শুধু নয় – শীত, বৃষ্টি , রৌদ্র থেকে নিজেকে রক্ষা করার নিমিত্তে গাছের বাকল,পাতা,পশুর চামড়া দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে রাখত। সভ্যতা বিকাশের সাথে সাথে অঙ্গ ঢাকার ব্যাপারটিরও ব্যাপক পরিবর্তন হতে লাগলো। মানুষ বিভিন্ন উদ্ভিদের পাতা,বাকল, আঁশ ও বিভিন্ন প্রাণীর পশম থেকে তন্তু সংগ্রহ করে কাপড় জাতীয় বস্তু তৈরি করে নিজেকে জড়িয়ে রাখতে শুরু করল। এভাবে শুরু হয়ে গেল বস্ত্র নামক বস্তুটির শিল্পায়ন। মানুষ এরপর শুধু প্রয়োজনে নয় বিলাসিতা ও আভিজাত্যের প্রতীক হিসাবে বস্ত্রকে ব্যবহার করতে শুরু করল।
আধুনিক বিশ্বে টেক্সটাইল শিল্পে নতুনত্বের ছোঁয়া দিন কে দিন বেড়েই যাচ্ছে। পোশাক নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও নিত্যনতুন নকশা ও আকর্ষণ নিয়ে হাজির হচ্ছে আমাদের মাঝে। কিন্তু আপনি জানেন কি বিশ্বের সবচেয়ে দামী, উষ্ণ ও মোলায়েম কাপড়ের নাম কী? অথবা কী দিয়ে তৈরি হয়ে থাকে সেই কাপড়? অনেকের কাছে হয়তো এখনও অজানা, বিশ্বের সবচেয়ে দামী, উষ্ণ ও আরামদায়ক কাপড় উৎপাদিত হয় এক প্রজাতির প্রাণীর পশম থেকে। প্রাণীটির নাম ভিকুনা। ভিকুনার পশম থেকে উৎপাদিত পোষাক জগদ্বিখ্যাত ‘কাশ্মীরি শাল’ থেকেও বহুগুণে দামী ও আরামদায়ক। ভিকুনা সুতা দিয়ে তৈরি একটি কোটের দাম বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৮ লক্ষ টাকার সমান।
রয়েল ফেব্রিক ভিকুনার ইতিহাসঃ
ঐতিহাসিকভাবেই ভিকুনার কাপড় অভিজাত পণ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। ইনকা সভ্যতার মানুষেরা বিশ্বাস করতো ভিকুনা হত্যা মহাপাপ; তাদের মধ্যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা রয়েছে। শুধুমাত্র রাজপরিবারের সদস্যরা জীবিত থাকাকালে এই মূল্যবান প্রাণীর পশম দ্বারা তৈরিকৃত পোশাক পরিধানের অনুমতি পেতেন। তবে সাধারণ মানুষ মারা গেলে, তাদের মৃতদেহের সাথে এক টুকরা ভিকুনা কাপড় দিয়ে দেয়া হতো। আর এই কাপড়কে অভিহিত করা হতো ‘ঈশ্বরের কাপড়’ হিসেবে। ইনকা সভ্যতার সময় ভিকুনা হত্যা মহাপাপ হওয়াতে সেসময় এই প্রাণীরা দ্রুত বংশ বিস্তার করতে থাকে। দক্ষিণ আমেরিকান অঞ্চলে প্রচুর সংখ্যক ভিকুনা বেড়ে উঠতে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৫৩২ সালে স্প্যানিশ বিজেতারা যখন ইনকা সাম্রাজ্য দখল করে নেয়, তখন থেকে তারা প্রচুর পরিমাণে ভিকুনা হত্যা করতে থাকে। সেসময় ভিকুনার গোশত ভক্ষণ ও চামড়া সংগ্রহে রাখা তাদের বিলাসিতায় পরিণত হয়। এছাড়া ভিকুনার পশম দ্বারা তৈরি সুতাকে বাণিজ্যিকভাবে তারা ‘নয়া বিশ্বের সিল্ক’ হিসেবে পরিচিত করে তোলে। এর ফলে মাত্র ১০০ বছরের ব্যবধানে এটি একটি দুর্লভ প্রাণীতে পরিণত হয়।
ভিকুনাদের আবাসস্থল:
এই দুর্লভ প্রাণীটির সন্ধান মেলে দক্ষিণ আমেরিকার স্বল্প কয়েকটি দেশে। বিশেষত চিলির অ্যান্ডিস আলটিপ্লানো পর্বতে তাদের বিচরণ করতে দেখা যায়। ক্যামেলিড পরিবারের প্রাণীদের মধ্যে ভিকুনা সবচেয়ে ছোট ও মায়াবী গঠনের হয়ে থাকে। এদের দেহের উপরিভাগ কমলা এবং নিচের অংশ সাদা রঙের পশম দ্বারা আবৃত থাকে। এই উষ্ণ পশমই মূলত তাদের পর্বতের ঠাণ্ডা আবহাওয়া থেকে রক্ষা করে। চিলির পাশাপাশি আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া ও পেরুতেও ভিকুনার সন্ধান মেলে। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ হতে ১০,০০০-১৫,০০০ ফুট উঁচু পর্বতভূমিতে তারা বসবাস করে।
ভিকুনা ফাইবার কি?
পৃথিবীতে লাক্সারি যত সুতা তৈরি করা হয় তার মধ্যে সেরা হলো ভিকুনা উল। এটি সাধারণত কমলা – বাদামী রঙের হয়ে থাকে। ভিকুনা প্রাণীটির একটি পশম মানুষের চুলের থেকে ৮ গুন চিকন। ভিকুনা ফাইবার খুবই নরম মসৃন এবং অন্যান্য প্রাণীর পশমের চাইতে আভিজাত্যময়।
ফাইবারটি বেশ মজবুত ও পানি ধরে না এবং স্থিতিস্থাপক। ভিকুনা উল দিয়ে প্রস্তুতকৃত পোষাক ওজনে অত্যন্ত হালকা পাতলা হলে ও শরীরের তাপমাএাকে প্রচন্ড গরম করতে সক্ষম। ১৯৬৫ সালে সর্বপ্রথম এ ফাইবারটি সংগ্রহ করার কাজ শুরু হয়। ১ কেজি “ভিকুনা” সুতার মুল্য ৬৯০ ইউ, এস, ডলার হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ৫৮০০০/ টাকা মাএ।
গাঠনিক বৈশিষ্ট্যঃ
-ফাইবারের মাইক্রোনেয়ার ১২-১৪ মাইক্রোমিটার
-ডায়ামিটার ৬-১২ মাইক্রোমিটার
-ফাইবারের দৈর্ঘ্য ৩৫ মি.মি.
ভিকুনা উল সংগ্রহের এক ঐতিহ্যবাহী প্রথাঃ
প্রতিবছর পেরুতে জুনের শেষের দিকে স্থানীয়দের ঐতিহ্যবাহী প্রথা “চাক্কু “অনুসারে ভিকুনার লোম সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু হয়।এই কাজের জন্য বিশাল এক এলাকা জুড়ে এই প্রাণীদের ঘিরে ফেলা হয় এবং শিকারীরা ক্রমশ তাদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে, যতক্ষণ না তাদের ধরা হয়। এই প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাণী বা পশমের কোন ক্ষতি না করে ভিকুনার লোম সংগ্রহণ করা। লোম সংগ্রহের পর স্থানীয় মহিলারা সেগুলো পরিস্কার করে, ১৫ সে.মি লম্বা লোমকে বাছাই করে প্যাকেট করে ফেলে।
একটি ভিকুনার দেহে বছরে মাত্র ১ পাউন্ড পরিমাণ পশম তৈরি হয় এবং প্রতি তিন বছরে মাত্র একবার তাদের দেহ থেকে পশম সংগ্রহ করা যায়।
ভিকুনা ফেব্রিক এতো দামি হওয়ার কারণঃ
ভিকুনার ফেব্রিক অতি চড়া মূল্য হওয়ার বিভিন্ন কারণ আছে তাহলো, বর্তমানে ভিকুনা একটি বিরল প্রজাতির প্রাণী। একটি ভিকুনা থেকে ৩/৪ বছরে একবার লোম সংগ্রহ করা হয় এবং তাদের দেহে বছরে মাত্র ১ পাউন্ড পরিমাণ পশম তৈরি হয় । আরেক সমস্যা হলো, তাদেরকে আবদ্ধ জায়গায় লালন পালন করা কিংবা ফার্মিং করা যায় না। ফলে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা ভিকুনাদের দেহ থেকে প্রতি তিন বছর পর পর যতটুকু পশম সংগ্রহ করা যায় তাকে মহাদুর্লভই বলা চলে।
কিছু দেশে এই প্রাণীটির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ভিকুনা উল আমদানি ও সংগ্রহ নিষিদ্ধ। ১৯৭৬ সালে ভিকুনা বিপন্ন প্রাণীর তালিকাভুক্ত হয় এবং জাতিসংঘ এটি সংরক্ষণের জন্য বিস্তর প্রস্তাব গ্রহণ করে। এতে ভিকুনা ক্রয়-বিক্রয়ের উপর করা নজরদারি আরোপ করা হয়। এই লোমের তৈরি কাপড় এতটা দামী হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ হচ্ছে এর দুর্লভতা।
ভিকুনার তৈরি কাপড় ও এর ব্যবহারঃ
ভিকুনার পশম থেকে উৎপাদিত কাপড় দিয়ে তৈরিকৃত পোশাকের ফিনিসিং এতোটাই মসৃন ও আরামদায়ক হয় যে, এর চেয়ে অভিজাত পোশাক আর অন্য কোনো উল দিয়ে তৈরি করা সম্ভব হয় না। পৃথিবীর খ্যাতিমান সেলিব্রিটি ও অর্থ বিও সম্পন্ন শৌখিন মানুেষর গায়ে দেখা যায় ভিকুনা কাপড়ের তৈরি পোশাক।
ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ভাষ্যমতে, ভিকুনার পশম দিয়ে তৈরি একেকটি কোটের মূল্য ২১,০০০ ডলারেরও অধিক। যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৮ লক্ষ টাকার সমান। ভিকুনার পশম দিয়ে তৈরি একেকটি মাফলারের দাম গড়ে ৪,০০০ ডলার; অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা। এ কাপড়ের প্রতি গজের মূল্য প্রায় ২৫০০০০ টাকা।
Writer: Ayesha Zulkernine WUB Research Assistant, Bunon