বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন যোগাযোগের দ্বারা ডেনিমের বিস্তৃত ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন সুযোগ তৈরি করেছে। ডেনিম রপ্তানিতে বাংলাদেশ দ্বিতীয় স্থানে চায়না এর পর অবস্থান করছে। শতাব্দী আগে, ডেনিম সীমিত পরিসরে ব্যবহৃত হলেও এর উপযোগিতার বহুমুখিতার সঙ্গে এখন ডেনিম এর চাহিদা বিশ্ববাজারে আকাশ উচ্চ অবস্থানে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের সমস্ত বৈচিত্র্যময় পোশাকের মধ্যে ডেনিম সর্বাধিক সম্ভাব্য আইটেম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশের ডেনিমের খ্যাতি এখন পৃথিবী জুড়ে, প্রধানত ইউরোপীয়ান দেশগুলোতে। ডেনিম এক প্রকার ফেব্রিক যা ১০০% কটন টুইল বা স্টেচ টুইল দ্বারা তৈরি। এখনকার অধিকাংশ মানুষের কাছেই ডেনিমের গুরুত্ব , বিশেষ করে জিন্স প্যান্টের গুরুত্ব অধিক। হাল আমলের ফ্যাশন জিন্স ব্যাতিরেকে কল্পনা করাটা একটু কঠিন। বিশেষ করে ছাত্র ও তরুন সমাজ তাদের প্রতিদিনকার জীবনযাত্রা ফাইভ পকেট ও রিভেট বিশিষ্ট জিন্সের প্যান্ট ছাড়া কল্পনা করতে পারে না। ইতিহাসবিদ, ডিজাইনার, সাংবাদিক, মুভি স্টার, লেখক থেকে শুরু করে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই ডেনিম ফেব্রিক সমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
ডেনিমের কিছু বৈশিষ্ট্য : ডেনিম ফেব্রিক স্বতন্ত্র কিছু গুণের আধিকারী,
- ডেনিম ফেব্রিকে সহজে ক্রিজ পড়ে না ।
- এটি খুব শাক্তিশালী এবং স্থায়ী।
- পরিধানের সময় শক্ত সুরক্ষা দেয়।
- ডেনিম ডাইং এ যদি ভ্যাট ও সালফার ডাই ব্যবহার করা হয় তাহলে পরিধানে গরম লাগবে না।
- প্রধানত আট প্রকার ডেনিম ফেব্রিক পাওয়া যায় । যেমন : কালারড ডেনিম, বাবল গাম ডেনিম , মার্বেল ডেনিম, রিভার্স ডেনিম ইত্যাদি।
বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য ডেনিম শিল্প প্রতিষ্ঠান ও সম্ভাবনা: বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ডেনিম শিল্পের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। আমাদের বাংলাদেশে ডেনিম দ্বারা তৈরি জিন্সের গঠনে গতানুগতিক ডিজাইনের বাইরেও বিভিন্ন বৈচিত্র্য এসেছে। এর মধ্যে আছে যেমন স্লিটিং ইফেক্ট , ফেডিং ইফেক্ট কিংবা লেজার এংগ্রেভিং ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক বাজারে ডেনিম ফেব্রিকের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সাথে স্থানীয় মিলগুলো বিশেষ করে এর বয়ন ও প্রক্রিয়াকরণের দিকে নজর দিচ্ছে। বাংলাদেশের ডেনিম ফেব্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং কারখানার তালিকার শীর্ষে থাকা উল্লেখযোগ্য ১০ টি নাম হচ্ছে : হা মীম ডেনিমস লিমিটেড, বেক্সিমকো ডেনিমস লিমিটেড , পারটেক্স ডেনিম , চট্টগ্রাম ডেনিমস লিমিটেড, প্যাসিফিক ডেনিমস লিমিটেড, এনভয় টেক্সটাইল লিমিটেড, যমুনা ডেনিমস লিমিটেড, আর্গন ডেনিমস লিমিটেড, শাশা ডেনিমস লিমিটেড, মাহমুদ ডেনিমস লিমিটেড।
ডেনিমের গ্লোবাল মার্কেট : আধুনিক বিশ্ব পুরোপুরি ফ্যাশন সচেতন। কোন পোশাকটা পরবো , কোনটা পরলে নিজেকে একটু নতুনভাবে উপস্থাপন করা যায় এটা নিয়ে সবার মাথা ব্যাথা।পোশাকের বৈচিত্র্য ও নিজেকে মার্জিত ভাবে উপস্থাপন করতে ডেনিম এগিয়ে আছে। ইউরোপ, আমেরিকা, চায়না ও জাপানের অধিকাংশ মানুষের প্রথম পছন্দের তালিকায় রয়েছে ডেনিমের পোশাক। প্রতি বছর গ্লোবাল ডেনিমের চাহিদা প্রায় ৭ বিলিয়ন মিটার যার ৭০% আসে আমাদের এশিয়া মহাদেশ এর দেশ যেমন বাংলাদেশ, চায়না, ভারত এবং পাকিস্তান থেকে। ইউ.কে ( UK ) এবং ইউ.এস.এ (USA) তে ডেনিম রপ্তানিতে বাংলাদেশ লিডিং অবস্থান ধরে রেখেছে। ডেনিমের টপ বায়ারগুলো আমাদের হাতে রয়েছে। কিছু পদক্ষেপ নিলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রায় মোটামুটি ৮০% এর মতন ডেনিমের গ্লোবাল চাহিদা মেটানো যাবে।

ডেনিম শিল্পের সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ : ডেনিম শিল্প বাংলাদেশের নীরব বিপ্লব। ২০০৪ সালের প্রথম দিকে মাত্র চারটি কারখানায় উৎপাদন শুরুর মাধ্যমে বাংলাদেশে ডেনিমের শুভ সূচনা হয়। বর্তমানে প্রায় ৩১ টি কারখানায় ডেনিম ফেব্রিক উৎপাদন চলছে। ডেনিমের বাজার কিন্তু অনেক বড় ও ব্যাপক। এর সাথে বুনন , রঙ করা কিংবা ফিনিশিং এর মতো বিষয়গুলো জড়িত। তাই এসব কাজের মাধ্যমে ডেনিম বাংলাদেশের শিল্প – বাণিজ্যে একটা চমক তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ডেনিমে এখন বাংলাদেশ আরও অনেক বড় স্বপ্ন দেখতে পারে।
বাংলাদেশের ডেনিম শিল্পের সাফল্যের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ হচ্ছে :
- ইইউ এবং মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের ডেনিম রপ্তানীতে শীর্ষস্থানীয় অবস্থান : ইউএস অফিস অফ টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল ( ওটেক্সা ) –এর তথ্য অনুযায়ী , ২০১৯ সালের জানুয়ারি – আগস্ট সময়কালে বাংলাদেশের বাজারে ডেনিম রপ্তানি ৫.৪২% বেড়ে ৫৭৩.২৭ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।
- শীর্ষস্থানীয় বৈশ্বিক ক্রেতাদের উপস্থিতি : বাংলাদেশ থেকে ব্লু ডেনিম ট্রাউজার্স , স্কার্ট , জ্যাকেট , স্যুট –কোট , প্লে স্যুট রপ্তানি হয় এবং ক্রেতারা হলো : এইচ অ্যান্ড এম , ইউনিক্লো , টেস্কো, লেভিস , ডিসেল , ওয়াংলার , জি-স্টার , এস অলিভার, হু গো বস , গ্যাপ,গুচি ও কেলভিন ক্লেইন।
- ভালো মানের ব্লু ডেনিম পণ্য : জাবের অ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক – এর অনল রায়হান মনে করেন , “ এখানকার পানি , ইন্ডিগো কালার এবং প্রতিযোগিতামূলক দাম ডেনিমে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । বাংলাদেশের পানি ও আবহাওয়া ডেনিমের জন্য ভালো।
- অত্যাধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ এবং অটোমেশন : চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ছোঁয়া বাংলাদেশের পোশাক শিল্পেও লেগেছে। অত্যাধুনিক মেশিন এর মাধ্যমে ডেনিম উৎপাদনের পরিমান বাড়ানোর প্রকল্প নেয়া হয়েছে।
ডেনিম শিল্পে সাফল্যের পাশাপাশি কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে, এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে :
১। দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি তেল , গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট বৃদ্ধি : ডেনিম শিল্পের আমাদের প্রতিযোগি দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অনেক কিছু সমন্বয় করেছে। যেমন : জ্বালানি তেলের দাম ভারত ও শ্রীলংকা নিয়মিত সমন্বয় করে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও আমাদের দেশে উল্টে বাড়ে।
২। প্রতিযোগিদের টেন্ডিয়ার এবং অভিনব আইটেমের উৎপাদন : ডেনিম এক্সপোর প্রবর্তক ও সিইও মোস্তাফিজ উদ্দিন মনে করেন , “ বাংলাদেশকে ডিজাইন উন্নয়ন এবং নতুনত্বের মাধ্যমে ডেনিমে অবস্থান সংহত করতে হবে। এই খাতে এমন আরো বিনিয়োগ এবং গবেষণা বাড়াতে হবে ক্রমবর্ধমান চাহিদাকে মাথায় রেখে”।
৩। ভারত ও মিয়ানমারের বিশ্ববাজার সম্প্রসারণের দিকে মনোনিবেশ।
৪। গ্রেডিং পণ্য সিস্টেমগুলির কারণে বিশ্বব্যাপী খুচরা বিক্রেতার কম দামের পণ্য ক্রয়।
৫। আমাদের দেশে পর্যাপ্ত বন্দর সুবিধা নেই , যার কারণে বিদেশী ক্রেতার আগ্রহ কমে যেতে পারে।
বাংলাদেশের ডেনিম শিল্পের সুযোগ :
বিশ্ববাজারে চাহিদা বাড়ছে বাংলাদেশি ডেনিমের : উন্নতমানের ডেনিম রপ্তানি , বিশ্বমানের কারখানা এবং শ্রমিকদের দক্ষতা উন্নয়নের ফলে এই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর ডেনিম কাপড় উৎপাদনে দেশের সক্ষমতা রয়েছে প্রায় ৩৬ কোটি গজ। আর ডেনিম চাহিদা রয়েছে প্রায় ৬০-৬৫ কোটি গজ। চাহিদার অর্ধেকের কম কাপড় উৎপাদিত হছে। ২০২১ সালের মধ্যে এই চাহিদা প্রায় ১২০ কোটি গজে দাঁড়াবে বলে মনে করা হচ্ছে। সুতরাং এই খাতে বিনিয়োগের ব্যাপক জায়গা রয়েছে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তারা।
পাট থেকে ডেনিম কাপড় : পাট থেকে ডেনিম কাপড় তৈরি বাংলাদেশের ডেনিম শিল্পের জন্য একটা সুবর্ণ সুযোগের দুয়ার খুলে দিয়েছে। ইনস্টিটিউট পাট ও তুলা একই রকম আঁশ জাতীয় দ্রব্যের সংমিশ্রণে সাশ্রয়ী মূল্যে সুতা উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। এ পদ্ধতি ব্যবহার করে স্বল্প মূল্যে উন্নতমানের জুট ডেনিম কাপড় তৈরি করা হচ্ছে যা বাংলাদেশের ডেনিম শিল্পের এক বিপুল সম্ভাবনাময় প্রকল্প।

পরিবেশবান্ধব ডেনিম: টেকসই উৎপাদন বিশ্ববাজারের একটা প্রচলন হয়ে উঠেছে। তাই বাংলাদেশের ডেনিম উৎপাদন কারখানাগুলোও পরিবেশ বান্ধব ডেনিম উৎপাদনের দিকে দৃষ্টিপাত করেছে। ডেনিম শিল্পে অন্যতম ‘ভাস্কর ডেনিম ইন্ডাস্ট্রিস লিমিটেড’ টেকসই ডেনিমের দিকে ধাবিত হয়েছে। সংস্থাটি তার টেকসই পদ্ধতির সাথে পরিবেশগত পরিণতি হ্রাস করার জন্য ধারাবাহিকভাবে চেষ্টা করছে। এই কোম্পানিটি হ্রাস-পুনঃব্যবহার-পুর্নব্যবহারের দর্শনে বিশ্বাস রেখে ডেনিম উৎপাদনের ক্ষেত্রে নিম্ন বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখে :
- পণ্য বিকাশ ও উদ্ভাবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে পুনর্ব্যবহারযোগ্য তন্তুগুলির ব্যবহার
- পানির ব্যবহার কমানো এবং পানির সাশ্রয় করা
- শক্তি সংরক্ষণ
- বৃষ্টির পানির সঞ্চয়করণ
এই লক্ষ্যে, ভাস্কর কোম্পানি নিজেই ওপেন এন্ড, রিং এবং কোর স্পিন সুতা তৈরি করে এবং এয়ারজেট, রেপিয়ার, ডবি এবং জ্যাকওয়ার্ড তাঁত ব্যবহার করে ডেনিম ফেব্রিক তৈরি করে।
অধিক পানি ও রাসায়নিকের ব্যবহার এড়িয়ে পরিবেশবান্ধব ডেনিম উৎপাদনে এখন লেজার প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করেছে বাংলাদেশের ডেনিম রপ্তানিকারক। বাংলাদেশের কারখানাগুলো বর্তমানে টেকসই ডেনিম এর উৎপাদনকারী দেশ হিসাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এজন্য অত্যাধুনিক রাসায়নিক উপাদান ব্যবহৃত হচ্ছে ডেনিম ফেব্রিক এর বিভিন্ন নান্দনিক চেহারা প্রদানের এবং ফিনিশিং প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে। অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাংলাদেশের কিছু শীর্ষস্থানীয় কারখানাগুলো গড়ে ১৫-১৬ লিটার পানি খরচ করে প্রতি কেজি ডেনিম ওয়াশিং এর জন্য।
ডেনিমের বহুমুখী ব্যবহার: আধুনিক বিশ্বে ডেনিম পোশাক খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। আমরা জানি যে এখনকার দিনগুলিতে পু্রুষদের ট্রাউজার, শার্ট, মহিলাদের পোশাকে ডেনিম ব্যবহার করা হয়। গ্রাহকদের মধ্যে এটার গ্রহনযোগ্যতা বাড়ছে। এখন ডেনিমের ব্যবহার বহুমুখী। মহিলাদের হ্যান্ডব্যাগ, স্কুল এবং কলেজ ব্যাগ, এবং ভ্রমণ ব্যাগ তৈরীর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ডেনিম। সুতরাং ডেনিম এর পরিসীমা দিন দিন বাড়ছে। সুতরাং ডেনিম জ্যাকেট, প্যান্ট, শর্টস, শার্ট, স্কার্ট, সুট, টুপি, বেল্ট, বুট এবং অ্যাথলেটিক জুতা, ডেনিম ওয়াইন ব্যাগ, ডেনিম পেন্সিল কেস, ডেনিম অ্যাপরন, ল্যাম্পশেডস, গৃহসজ্জার সামগ্রী ইত্যাদি। ডেনিম এর সাধারণ ব্যবহার ছাড়া, কিছু খুব আকর্ষণীয় পণ্য আছে; যেমন : ডেনিম হেলমেট, ডেনিম শাড়ি, সানগ্লাস ফ্রেম, কুকুর এবং পোষা প্রাণী জন্য ডেনিম কোট, ডেনিম আন্ডারওয়্যার, ডেনিম মুখ মাস্ক, ডেনিম মোবাইল কেস।

ফ্যাশন এবং স্টাইলের পরিবর্তনের সাথে, ডেনিম পুরুষ এবং মহিলাদের সকল মৌসুমের পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য ডেনিম শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। পরামর্শমূলক পরিসেবা, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি সরবরাহ করতে হবে যেন ডেনিমের দক্ষতা, নকশা এবং সংযোজন মুল্য উন্নত করা যায় এবং এতে করে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব ডেনিম এর উৎপাদন এবং রপ্তানি বৃদ্ধি সম্ভব। ডেনিম বাংলাদেশের জন্য সম্ভাব্যময় রপ্তানি পণ্য হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে। প্রতিবছর প্রায় ২.১ বিলিয়ন এর মতন ডেনিম বিশ্বব্যাপী বিক্রি করা হয়।
Writer: Puja Kundu, BUTEX Research Assistant, Bunon