বাংলাদেশের একজন সফল টেক্সটাইল প্রকৌশলী মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান। তিনি ১৯৯৭-৯৮ সালের দিকে তৎকালীন কলেজ অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টেকনোলজি যার বর্তমান নাম বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়, বুটেক্স থেকে তার শিক্ষা জীবন শেষ করেন।
সিনহা টেক্সটাইল গ্রুপে উইভিং এ তার কর্ম জীবন শুরু হয়। এরপর তিনি চলে যান বেক্সিমকো টেক্সটাইলে, সেখানেও সে দীর্ঘদিন ওভেন প্রি-ট্রিটমেন্ট, ডাইং ফিনিসিং এ কর্মরত ছিলেন। তারপর তিনি মনে করেছেন ব্যবস্থাপনায় তাঁর আরও ভালো কাজ করার সম্ভাবনা আছে। এই চিন্তা থেকে তিনি তৎকালীন ওপেক্স গ্রুপে মার্চেন্ডাইজিং এ যোগ দেন। ওখানে ৩ বছর কাজ করার পরে তিনি সিঙ্গাপুর ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান টেক্স-ইবো ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড এ মার্চেন্ডাইজার হিসেবে যোগদান করেন।
সেখানে তিনি দীর্ঘ ৮ বছর থাকার পর তিনি মাদারকেয়ার সোর্সিং লিমিটেড (ইউকে)-তে কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে যুক্ত হন। এরপর বেশ কয়েক বছর সেখানে থাকার পরে তিনি আবার টেক্স-ইবো ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড ফিরে আসেন। তিনি বর্তমানে টেক্স-ইবো ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড এর কান্ট্রি ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছেন।
বাংলাদেশে টেক্সটাইলের বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও সম্ভাবনা ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে বুননের সঙ্গে কথা বলেছেন টেক্স-ইবো ইন্টারন্যাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড এর কান্ট্রি ম্যানেজার মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দীপংকর ভদ্র দীপ্ত।
বুনন: বর্তমানে টেক্সটাইলে চাকুরীর বাজার কেমন?
মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান: বাংলাদেশে প্রায় দশ হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে টেক্সটাইল এবং গার্মেন্টস রিলেটেড। অসংখ্য দক্ষ জনশক্তি প্রয়োজন এখানে। কারণ দক্ষ জনশক্তি ছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে আমরা পিছিয়ে পড়ছি। সেই হিসাবে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়াদের চাকুরী বাজার ভালো বলা যায়।
বুনন: বাংলাদেশের বর্তমান টেক্সটাইলের সার্বিক অবস্থান কি?
মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান: আমরা কাঁচামালে জন্য বাইরের দেশগুলোর প্রতি অনেকটাই নির্ভরশীল। সেই থেকে আমাদের যে সমস্যাটা হয় শুধুমাত্র স্টিচিং বা কাটিং মেকিং কস্ট থেকে আমাদের ফুল বেনিফিটটা পেতে হয়। আমরা শাব্দিক অর্থে ৩৫-৪০ বিলিয়ন ডলারের কাজ করলেও আমাদের কাঁচামাল আনতেই প্রায় ৪ ভাগের ৩ ভাগ, অর্থাৎ ৭৫ ভাগ খরচ চলে যায়।
বুনন: বাংলাদেশ কি কি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে?
মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান: আমাদের লজিস্টিকে বড় ধরণের সমস্যা আছে। আমাদের পোর্টে এখনও তেমন আধুনিকায়ন হয় নি। আমাদের ঢাকা চিটাগাং রোডেরও প্রতিশ্রুত উন্নতি হয় নি। কমিউনিকেশনের অবস্থান আমাদের এখনও অনেক খারাপ।
ওই হিসেবে টেক্সটাইলটা যেখানে যাওয়ার কথা, যে স্বপ্ন আমাদের ছিল সেটা আসলে সম্ভব হয়নি। কারণ আমাদের জ্বালানির অন্যতম সাশ্রয়ী মাধ্যম গ্যাস সরবরাহে সংকট আছে, যাতায়াত ব্যবস্থা সমস্যা, কাঁচামালের সমস্যা সব মিলিয়ে আমাদের যে আকাঙ্ক্ষা ছিল সেই জায়গাতে আমরা পৌছাতে পারি নি। এই জায়গাগুলোতে আমাদের অনেক কিছু করার আছে।
গত ৩০ বছরে আমাদের দক্ষ জনগোষ্ঠী বাড়ানোর যে প্রচেষ্টা ছিল সেটা খুব ধীরে ধীরে হয়েছে। অন্যান্য টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস নির্ভর দেশগুলোর তুলনায় আমাদের এফিসিয়েন্সি বেশ কম।
বুনন: কীভাবে সমস্যাগুলো মোকাবিলা করা যায়?
মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান: আমাদের যে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেটআপ আছে, টেক্সটাইল মেশিনারিজ আছে এখানেই যদি আমরা ভ্যালু অ্যাডেড প্রোডাক্ট তৈরি করতে পারি, তবে আমাদের রপ্তানি দ্বিগুণ করা সম্ভব। কটনের পাশাপাশি যদি আমরা পলিয়েস্টার, নাইলন ইত্যাদি ম্যান মেড ফাইবার বা স্পোর্টস আইটেম উৎপাদনে বেশি মনোযোগ দেওয়া দরকার। যে প্রোডাক্ট এর দাম আমাদের এখানেও ২-৩ ডলার সেটা অন্য দেশ কিছু ভ্যালু যুক্ত করে ৫-৬ ডলার দিয়ে বায়ারদের ধরতে পারছে। এটা করতে পারলে আমাদের রপ্তানি আয় কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে।
বুনন: বাংলাদেশের প্রথম দিকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মসংস্থান কেমন ছিল?
মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান: পূর্বে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারদের কর্মসংস্থানে একমাত্র জায়গাই ছিল হয় স্পিনিং ফ্যাক্টরি, উইভিং ফ্যাক্টরি অথবা ডাইং ফিনিশিং। গার্মেন্টস মার্চেন্ডাইজিং এ টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়াররা আসা শুরু করেছে ২০০০ সালের পর থেকে।
নব্বই দশকে যখন নীট ফ্যাক্টরি বাড়া শুরু করল তখন আমাদের দক্ষ প্রকৌশলীর প্রয়োজন হতো। কারণ এগুলো নন-টেকনিক্যাল লোক দিয়ে করা সম্ভব না। নব্বই এর আগে আমরা নীট ফেব্রিক শত ভাগ আমদানি করতাম চায়না এবং ইন্ডিয়ান ত্রিপুর থেকে। তারপর আমাদের টেক্সটাইল প্রকৌশলীরা নীট সেক্টরে রীতিমত বিপ্লব ঘটিয়েছেন। তারা বাংলাদেশেই তৈরি করা শুরু করেন নীট ফেব্রিক। এই চেঞ্জ সার্কুলার নীট প্রোডাক্ট রফতানিতে বাংলাদেশকে নির্ভরশীল থেকে পুরোপুরি আত্মনির্ভরশীল করে তোলে।
বুনন: ভবিষ্যৎ টেক্সটাইলের উন্নতির জন্য আমাদের কি করতে হবে?
মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান: আমাদের যেটা করতে হবে নেগোসিয়েশনের জায়গাটা বাড়াতে হবে। আমরা সবাই ক্রেতার আনা স্যাম্পলের উপর নেগোশিয়েট করে থাকি। যেটা সম্পর্কে ক্রেতা ভালো ভাবেই জানে। কিন্তু ব্যাপারটা যদি উল্টো হতো– আমরা আমাদের মতো করে প্রোডাক্ট ডিজাইন এবং ডেভেলপ করতাম। সেটা যখন আমরা ক্রেতা কে দিতাম সেখানে ক্রেতা জানার সুযোগ থাকত কম। কারণ প্রোডাক্টটা আমরা ডেভেলপ করেছি এবং এই প্রোডাক্ট সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা থাকত না।
এই জায়গাতেই আমরা অনেক পিছিয়ে আছি পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায়।
আমি বলব প্রতিটা ইন্ডাস্ট্রিতে রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট থাকতে হবে। কারণ আমরা খুব কম ভ্যালু অ্যাডেড আইটেম করছি। বেসিক প্রোডাক্টের দামটা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে আমরা আর টিকতে পারছি না। আমাদের যে পরিমাণ লাভ হচ্ছে এভাবে আমরা বেশিদিন টিকতে পারব না, যদি না আমরা নতুন করে রিসার্চ এবং ডেভেলপমেন্ট করি।
বুনন: টেক্সটাইলে এমএসসি নাকি এমবিএ? কোনটাকে আপনি এগিয়ে রাখবেন?
মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান: পূর্বে আমাদের সময় টেক্সটাইলে এমএসসি করার সুযোগ ছিল না। আমার মনে হয় এমএসসি করার সুযোগটা বাংলাদেশে গত দশ বছরে এসেছে। তার আগে আমাদের বাংলাদেশে মাস্টার্স করার সুযোগ ছিল না। তখন মাস্টার্স করলে বাইরের থেকে করতে হতো।
টিচিং প্রফেশনে গেলে অবশ্যই এমএসসিটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এবং ইনোভেশনেরও সুযোগ থাকে।
তবে কর্পোরেট বা ইন্ডাস্ট্রিতে আসলে আপনাকে যাদের সাথে চলতে হচ্ছে সবাই কমার্শিয়াল। এখানে আপনাকে ব্যাংকের বিভিন্ন ধাপ, ম্যানেজমেন্টের বিভিন্ন বিষয় আপনাকে বুঝতে হবে। আর এগুলো বুঝতে হলে এমবিএ একটি ভালো ডিগ্রি।
বাংলাদেশে ইনোভেশনের জায়গা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি বলব যে যারা প্রোডাকশনে থাকবেন তারা অবশ্যই এমএসসি করবেন। আর কেউ যদি প্রোডাকশনে না থাকেন তাহলে আপনি এমএসসি করতেও পারেন কিন্তু এমবিএ করাটা আপনার জন্য ভালো হবে। যা কমার্শিয়াল কাজে আপনার সুবিধা হবে।
দুটো ডিগ্রিই সমান গুরুত্বপূর্ণ, নির্ভর করবে যে আপনি কোথায় যাচ্ছেন।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন-
দীপংকর ভদ্র দীপ্ত
টিম লিডার, ন্যাশনাল অ্যাফায়ার্স রিপোর্টার টিম, বুনন