বছর দুয়েক আগেও বেশিরভাগ মানুষই পিপিই সম্পর্কে জানতো না। কিন্তু করোনা সংক্রমণের পর সর্বপ্রথম যে বিষয়টি ব্যাপকভাবে পরিচিত লাভ করেছে, তা হল পিপিই। পিপিই মানে হল পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট অর্থাৎ ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম।
করোনা আসার পরে পিপিই এর চাহিদা বিশ্বব্যাপী অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। নতুন নতুন অনেক ক্ষেত্রেই পিপিই এর ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আগে ছিল না। সেই চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে পিপিই এর মান উন্নয়ন।
পিপিই
পিপিই মুলত এমন কিছু উপকরণ এর সমাহার যা আপনাকে যেকোন ছোঁয়াচে রোগের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করবে। পিপিই অর্থাৎ পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট শুধুমাত্র পরিধান করলেই হয় না, তা খোলা এবং পড়ার সময় যথাযথ সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। নাহয় সেই পিপিই থেকেই সংক্রমনের একটি সম্ভাবনা থেকে যায়।
কোনো বিশেষ ধরনের কাপড় নির্দিষ্ট করে দেয়া না হলেও এনএইচএস এর মতে এটি তৈরিতে এমন কাপড় ব্যবহার করা উচিত যার পক্ষে কোনো ধরনের কোনো তরল পদার্থ শুষে নেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ সর্বাবস্থায় শুষ্ক থাকবে এমন কাপড় পিপিই তৈরীর জন্য উপযুক্ত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিবৃতি অনুযায়ী নিচের পাঁচটি উপকরণ থাকলে তবেই একটি পিপিই পর্যাপ্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারবে-
- মাস্ক
- গ্লাভস
- চোখ সম্পূর্ণভাবে ঢাকতে পারে চশমা
- ফেইস শিল্ড বা মুখের আবরণ
- সম্পূর্ণ শরীর ঢাকতে পারে এমন গাউন।
করোনাভাইরাস এর জন্য তৈরি পিপিইতে অবশ্যই নাক, মুখ এবং চোখ ঢাকার ব্যবস্থা থাকতে হবে। কিন্তু শ্বাস প্রশ্বাসে যেন কোনো সমস্যা না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
কেন পিপিই পরতে হবে
পিপিই যে শুধুমাত্র যে ব্যক্তি পরিধান করছেন তার সুরক্ষা নিশ্চিত এর জন্য প্রয়োজন তা কিন্তু নয়। যে ব্যক্তি করোনা সংক্রমনের ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে থাকেন বা কাজ করেন তিনি যদি উপযুক্ত সাবধানতা অবলম্বন না করেন তবে তার মাধ্যমে অন্যান্যরাও আক্রান্ত হতে পারেন। তাই সেই ব্যক্তির নিজের সুরক্ষা এবং তিনি যেন বাহক হিসেবে কাজ না করেন সেজন্যই পার্সোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট পরিধান আবশ্যক।
পিপিই বিভিন্ন ধরনের হলেও কার জন্য কোন ধরনের পিপিই প্রয়োজন অথবা কার্যকর তা নির্ভর করছে এটি পরিধান করে কি ধরনের কাজ করা হচ্ছে তার ওপরে।
কেউ যদি সরাসরি কোনো রোগীর সংস্পর্শে না যায়, তবে তার জন্য পুরো সেটের প্রয়োজন নেই। কিন্তু যারা সরাসরি রোগীদের সংস্পর্শে থাকছেন যেমন চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে জড়িত রয়েছেন যারা তাদের জন্যে পুরো পিপিই সেট সম্পূর্ণভাবে পরিধান করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকেন চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাই তাদের মধ্যে সংক্রমণের হার কমানোর জন্য সম্পূর্ণ পিপিই সেট পরিধান আবশ্যক।
অপরদিকে আক্রান্ত রোগীর থেকে শুধুমাত্র ডাক্তার সংক্রমিত হয়েই শেষ নয়। ডাক্তার থেকেও রোগীদের সংক্রমনের ঘটনা ঘটে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতি দশ জন রোগীর মধ্যে একজন রোগীর সংক্রমণ ডাক্তারের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই সংক্রমণের হার কমিয়ে আনতে ব্যক্তিগত সুরক্ষার সরঞ্জামাদি গুলো পরিধান অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাড়িয়েছে।
পিপিই এর বিকাশ
বিগত কয়েক দশক ধরেই শিল্প প্রতিরক্ষামূলক পোশাকগুলো কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাকে বাজারের একটি প্রধান চালিকা শক্তিতে রূপান্তরিত করেছে। লক্ষ লক্ষ কর্মচারীকে আহত হওয়া এবং মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষার জন্য ক্রমাগত পিপিইকে বিকশিত করতে হয়েছে। কিন্তু করোনা আসার পরেই এই পিপিই গুলো কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল।
সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পিপিইতে উল্লেখযোগ্য মান উন্নয়ন হয়েছিল যার গতি মূলত করোনা সংক্রমনের কারণে ত্বরান্বিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি বিষয়ে আমরা এখানে উপস্থাপন করছি।
আরামদায়ক
পিপিই সাধারণত ডাক্তার নার্স এবং সার্জন পরিধান করে থাকেন এবং তাদেরকে একটি দীর্ঘ সময় ধরে হাসপাতালে গরমের মধ্যে কাজ করতে হয়। তাই তাদের কথা চিন্তা করেই পিপিইতে থাকা ফেইস শিল্ড এবং গাউনের ডিজাইনে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করা হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে পরিবেশগতভাবে নিয়ন্ত্রিত পিপিই তৈরীর পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে যা শরীরের তাপমাত্রাকে আশেপাশের পরিবেশ অথবা আবহাওয়ার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে সহায়তা করবে। যাতে করে পিপিই পরিধানকারীকে গরম এবং অস্বস্তিতে না ভুগতে হয়।
চোখের সুরক্ষাকারী
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে যে কোনো ধরণের কাজের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনার চোখকে সুরক্ষিত রাখা। কারণ আমরা জানি, করোনা সংক্রমনের অন্যতম প্রধান পথ হচ্ছে চোখ, নাক এবং মুখ। তাই চোখের নিরাপত্তা বজায় রাখতে নতুন এক ধরনের সিল তৈরি করা হয়েছে যা মূলত ফোমের তৈরি এবং যা আপনার চশমার ফ্রেমটিকে মুখের সাথে ভালোভাবে আটকে রাখতে সাহায্য করে। যার ফলে যেকোনো ধরনের ময়লা বা ধূলিকণা আপনার চোখে পড়তে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সেই সাথে এই ফোমটির কারণে মুখের মাংসপেশিতে কোন রকমের কোন চাপ পড়ে না। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো এটি পরিধানকারীর দৃষ্টিশক্তি এবং চলাফেরায় কোন রকমের কোন বাধা সৃষ্টি করে না।
উন্নত মানের কাপড়
সুরক্ষামূলক পোশাকগুলো সাধারণত এমন কাপড়ের হওয়া উচিত যেগুলো অবিশ্বাস্য রকমের শক্ত এবং যেকোন কিছুই প্রতিরোধ করার ক্ষমতা যার রয়েছে। এই পোশাকের প্রধান উদ্দেশ্যই হচ্ছে পরিধানকারীকে বিভিন্ন ক্ষতিকর উপাদান যেমন আগুনের শিখা, প্রচণ্ড তাপ, চাপ ইত্যাদি থেকে রক্ষা করা। আর তাই পলিঅ্যামাইড, পিবিআই, আরমিড এবং তার মিশ্রন, ইউএইচএমডাবলু পলিইউরিথেন এবং আরো অন্যান্য বিপদজনক উপাদানের সাথে খাপ খাওয়ানোর মতো কাপড় তৈরীর চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি
ইদানিং আমাদের জীবনের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিধেয় প্রযুক্তির প্রথা শুরু হয়েছে। স্মার্টওয়াচ এবং ফিট বাই তার দুটি খুবই প্রচলিত উদাহরণ। এই পরিধেয় প্রযুক্তিটি যখন যুক্ত হয় তখন তা সুরক্ষা ব্যবস্থাপনার উন্নতি এবং কর্মক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এতে থাকা সেন্সরগুলি এখন রাসায়নিক গ্যাস, শব্দ এবং এর মতো বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে সক্ষম। যার ফলে তাদের ব্যাপারে পরিধানকারীকে সতর্ক করে দিতে পারে এবং প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিতে পারে। কেবল তাই নয়, পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে পরিধানযোগ্য প্রযুক্তি গুলো আসলে দুর্ঘটনা ঘটে বাধা দিয়ে দীর্ঘমেয়াদী ব্যয় সাশ্রয় করার জন্য উপযুক্ত।
এই নতুন উন্নত মানের পিপিই পণ্যগুলোর উদ্বোধনী উদ্ভাবনী বিকাশ করোনা ভাইরাস সংক্রমিত এই নতুন বিশ্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তীব্র চাহিদা, সরকারি বিধি নিষেধ এবং উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগের সাথে সামঞ্জস্য রেখে দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়েছে।
বাজারের বর্তমান অবস্থা
কোভিড-১৯ সংক্রমণের আগে বাছাইকৃত কয়েকটি সেক্টরে পিপিই ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে করোনার কারণে এর ব্যবহার অনেক বেশি বেড়ে গিয়েছে। যার কারণে বাজারে এর চাহিদাও দিনকে দিন বাড়ছে।
করোনার কারণে বিভিন্ন দেশে আমদানি রপ্তানির ছাড়াও পিপিই উৎপাদন অনেকগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জামের বাজার মূল্য ২০২০ সালে ৭৭.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছিল এবং ২০২০ থেকে ২০২৮ পর্যন্ত ৭.৩% এর যৌগিক বার্ষিক বৃদ্ধির হার (সিএজিআর) বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া উন্নত প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং পণ্যের মূল্য-কর্মক্ষমতার অনুপাতের বর্ধমান সচেতনতার মতো উপাদানগুলি বেসরকারী-লেবেলের পণ্য উত্পাদনকে সমর্থন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। মূলত উত্তর আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের উন্নত অর্থনীতিগুলিতে, গ্রাহকের নির্দিষ্ট চাহিদা অনুসারে ডিজাইন করা পিপিই এর চুক্তিভিত্তিক উৎপাদন বৃদ্ধি,এসকল পণ্যের চাহিদা বাড়ানোয় অনেক বড় একটি প্রভাব ফেলে।
চাহিদা-সরবরাহের ব্যবধান কমাতে এশীয় দেশগুলিতে টেক্সটাইল শিল্পে পরিচালিত সংস্থাগুলি তাদের পোশাক উৎপাদন কেন্দ্রগুলি কোভিড -১৯-এর প্রাদুর্ভাবের পরে পিপিই উৎপাদন কেন্দ্রে পরিবর্তিত করেছে। চীন হল পিপিই যেমন মুখোশ, গগলস, প্রতিরক্ষামূলক গাউন এবং গ্লোভস ইত্যাদির বৃহত্তম রপ্তানিকারী, তবে মহামারীর উত্থানের পরে এর রপ্তানি প্রায় ১৫% হ্রাস পেয়েছে।
শেষ কথা
বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে পিপিই আমাদের সংক্রমণের হার কমাতে অনেক বেশি সাহায্য করছে। গবেষকরা পিপিইর মানোন্নয়নের জন্য নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। আশা করা যায়, হয়তো অচিরেই এটি সম্পূর্ণভাবে জীবাণু প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করবে। কিন্তু ততদিন পর্যন্ত পিপিই ব্যবহারে সকলকে যথাসম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
লিখেছেনঃ আনিকা তাবাসসুম রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট ,বুনন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নোয়াখালী