ব্যাপক বাণিজ্য কূটনীতির সংস্কার এবং অর্থনৈতিক নীতির উন্মুক্ততা ভিয়েতনামকে আজ সেরা ২০ টি দেশের তালিকায় আসতে সাহায্য করেছে। উদাহরনসরূপ ১৯৮০-৯০ সালের দিকে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনাম রপ্তানিতে ও বিনিয়োগ আকর্ষণে (FDI= Foreign Direct Investment) প্রায় কাছাকাছি অবস্থানে ছিল। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনাম উভয়ের রপ্তানি পরিমাণ ছিল প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছর বাংলাদেশের রপ্তানি যেখানে ছিল ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার সেখানে ভিয়েতনামের ছিল ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার।
১৯৮০ এর পরবর্তী সময়ে ভিয়েতনাম বাণিজ্য কূটনীতির পরিবর্তন করলে এবং বিশেষ কিছু কারনে প্রচুর বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ ( FDI ) আকৃষ্ট করেছিল। ফলে বর্তমানে ভিয়েতনাম মোট রপ্তানির দিক দিয়ে বেশ ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছে গেছে।
কোভিডের পূর্বে ভিয়েতনামের অর্থনীতি গ্রোথ-রেট ছিল ৭% এবং এই পরিস্থিতিতেও ২০২১ সালে আনুমানিক গ্রোথ-রেট ৬.৫% যা খুবই অবাক করার মত। ২০২০ সাল অনুযায়ী ভিয়েতনামের মোট রপ্তানি ৩৪৮ বিলিয়ন ডলার, যার ৪১% ইলেকট্রিকাল ম্যাশিনারি থেকে, ১১% অ্যাপারেল থেকে এবং ৮% ফুটওয়ার থেকে। আমাদের দেশের রপ্তানির সিংহভাগ যেখানে দখল করে আছে পোশাক শিল্প সেখানে ভিয়েতনাম ৩০ বছরের ব্যবধানে ইলেকট্রিকাল, মেশিনারিজ ও পোশাক খাত সব দিক থেকেই প্রায় এগিয়ে। বর্তমানে বাংলাদেশ-ভিয়েতনামের পোশাক রপ্তানি পরিমানের পার্থক্য খুবই কম। কিছু মাস আগেও ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে টোপকে দ্বিতীয় অবস্থান দখল করে নিয়েছিল, যদিও বাংলাদেশ এখন পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে।

ভিয়েতনামের দ্রুত গতিতে এগিয়ে যাওয়ার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করেন চেয়ারম্যান অফ এএসকে অ্যাপারেল এন্ড টেক্সটাইল সোরসিং লিমিটেড এবং হেড অফ অপারেশন অফ বুনন মোঃ সালাহ উদ্দিন। উল্লেখিত কয়েকটি কারণ হলঃ
১. ইউরোপিয়-ভিয়েতনাম ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট। যার ফলস্রুতিতে পোশাক রপ্তানির সাথে সাথে অন্যান্য সেক্টরও রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে।
২. দেশের ভৌগোলিক অবস্থান অন্যতম প্রধান একটি কারণ। যেখানে আমদের দেশে তৈরি পোশাক বন্দরে পৌঁছাতে ১ দিন সময় লাগে সেখানে ভিয়েতনামের ০.৩ দিন লাগে। যা বিদেশী বায়ারদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট।

৩. ভিয়েতনামের ট্রেড ডিপ্লমেসি বাংলাদেশ থেকে অনেকাংশেই এগিয়ে। তাদের সন্ধিস্থাপনের স্কিলকে কাজে লাগিয়ে পোশাক খাতসহ অন্যান্য সেক্টরেও ভালো ব্যাবসা করছে।
গত তিন দশকে ভিয়েতনাম কী এমন পদ্ধতি গ্রহন করে এগিয়ে গেল, শুক্রবার এক ওয়েবিনারে সে নিয়েই আলোচনায় বসেছিলেন দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা। তারই কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারন হলঃ রপ্তানিবান্ধব নীতিমালা, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে উদারনীতি, রপ্তানিপণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ, কাস্টম ক্লিয়ারেন্স, ট্যারিফ রেট, লজিস্টিকসে দুর্বলতা ইত্যাদি।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) কর্তৃক আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে প্রতিষ্ঠানটির ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ বলেন, ১৯৯০-এর দশকে তেল-নির্ভরতা থেকে রপ্তানিপণ্যে বৈচিত্র্য এনে ভিয়েতনাম কীভাবে তাদের রপ্তানিমুখী শিল্পে সাফল্য পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, রপ্তানিতে তারা (ভিয়েতনাম) একটি খাতনির্ভর হয়ে থাকেনি, বরং বিভিন্ন খাতে গিয়েছে। অথচ এখনো বাংলাদেশের রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি আসে একটি খাত থেকে।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য তথা রপ্তানি বাড়াতে সরকারের নীতির আমূল সংস্কার প্রয়োজন। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে দূরদর্শী ও কার্যকর অর্থনৈতিক কুটনীতি জোরদার করতে হবে। সারা বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ ব্যাপক হার বাড়াতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ‘আমাদের গভরনেন্সের এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তিনি বলেন, দক্ষিণ কোরিয়ার মোবাইল টেক জায়ান্ট স্যামসাং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চেয়েছিল এবং দক্ষিণ কোরিয়ার আরেকটি সংগঠন ইয়ং-ওয়ান কর্পোরেশন, যার দেশে বড় ব্যবসা আছে, স্যামসাংকে বাংলাদেশে আনার জন্য আলোচনা করেছিল।
অবশেষে, স্যামসাং এখানে আসেনি কারণ ইয়ং-ওয়ান চট্টগ্রামে তার রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) জমি দিতে পারেনি কিছু জমি সংক্রান্ত বিরোধের কারণে। বিগ টেক কোম্পানি স্যামসাং চলে গেল ভিয়েতনামে এবং এরই সাথে ভিয়েতনাম ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস রপ্তানির বিকাশ শুরু হয়। যার ধারাবাহিকতায় ভিয়েতনাম এখন প্রথম ২০ টি সর্বাধিক রপ্তানিমুখর দেশের একটি।
আলচনায় শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী তার বক্তব্যে বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধরে সবকিছুতে ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করা একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখা দরকার, দে আর ওয়ান পার্টি স্টেট, যা বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে মেলানো যাবে না। তাদের অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের মিল নেই।’ তবু তিনি আলোচনা থেকে উঠে আসা বিভিন্ন সুপারিশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখার আশ্বাস দেন। আলোচনায় অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী নেতারা বাংলাদেশের রপ্তানিতে বাণিজ্য নীতির সংস্কার এবং সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
রিপোটার:
মাসুম আহমেদ
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সটাইলস (বুটেক্স)
ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর, বুনন
Reference:
https://www.thedailystar.net/
https://tbsnews.net/