পুরোটা পড়ার সময় নেই? ব্লগটি একবারে শুনে নিন!
মণীষীদের মতে, লোকশিল্পের মধ্যে অতীতের প্রতিধ্বনি, সমকালের অভিধান ও ভবিষ্যতের প্রতিরূপ প্রতিফলিত হয়। বাংলার লোকশিল্পের কথা উঠলেই সবার আগে মাথায় আসে বাংলার সূচিশিল্প, নকশিকাঁথা এবং ঐতিহ্যবহনকারী বিশেষ কাপড় খাদি। বতর্মানে আশার কথা এই যে, হালের ফ্যাশন ডিজাইনাররা উন্নত প্রযুক্তিতে গৌরবময় খাদি এবং ঐতিহ্যবাহী নকশি কাঁথার সমন্বয় ঘটিয়ে ফ্যাশন দুনিয়ায় এক নতুন ট্রেন্ড চালু করেছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো, প্রায় হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যগত শিল্প দুটোকে নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহনযোগ্যতার ক্ষেত্র প্রসারিত করে বিশ্ব ফ্যাশন অঙ্গনে শিল্প দুটোকে পরিচয় করিয়ে এর ব্যবহার ও চাহিদার ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটানো।
গৌরবময় খাদি ও কাঁথা নকশার ইতিহাস
অতীতে খাদি খদ্দর নামে পরিচিত ছিল। খাদি সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে। সিল্ক সুতা থেকে যে খাদি তৈরি তাকে সিল্ক খাদি এবং সুতি সুতা থেকে যে খাদি তৈরি হয় তাকে সুতির খাদি বলে। কার্পাস তুলা থেকে তৈরি হতো সুতা এবং সে সুতাকে ব্যবহার করে তৈরি হতো খাদি কাপড়। খাদির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গৌরবময় এক অধ্যায়৷ স্বদেশি আন্দোলনের সময় বর্জন করা হয়েছিল কলের তৈরি কাপড়৷ সেই সময় চরকায় হাতে কাটা সুতা দিয়ে তৈরি কাপড় পরাই ছিল দেশপ্রেমের প্রতীক৷ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সময় পুরো ভারতবর্ষে এই খদ্দরকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন মহাত্মা গান্ধী৷ বাংলাদেশে খাদির বাজার প্রসার ও পরিচিতি লাভের ক্ষেত্রে শৈলেন গুহ গুরত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখেন৷ চট্টগ্রাম থেকে এসে কুমিল্লার চান্দিনায় তিনি গড়ে তোলেন খাদির কাপড় তৈরির প্রতিষ্ঠান ‘গ্রামীণ খাদি’৷ এরপর নোয়াখালীর গান্ধী আশ্রমে তৈরি হয় খাদি৷

অপরদিকে,নকশি কাঁথা আমাদের দেশীয় ঐতিহ্য। গ্রামীন নারীরা সাধারণত পুরাতন কাপড়ের পাড় থেকে সুতা তুলে অথবা তাঁতীদের থেকে নীল, লাল, হলুদ প্রভৃতি সুতা কিনে এনে সুনিপুন হাতে কাপড় সেলাই করে মনের মাধুরি মিশিয়ে বিভিন্ন নকশা করে। নকশিকাঁথায় আমরা প্রতিনিয়ত খুঁজে পাই আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি, সমাজ-সভ্যতা, প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য, গৌরবগাথা ও সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। নকশিকাঁথায় এ দেশের গ্রামীণ নারীদের লোকায়ত ভাবনা, আবেগ আর কল্পনার আরেক রূপ।নকশি কাঁথার নকশাগুলোতে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে।
আধুনিক ফ্যাশনের ডিজাইনের খাদি প্রভাব
ঐতিহ্যের সাথে আধুনিকতার ছোয়ায় খাদিতে যুক্ত হচ্ছে নিত্যনতুন চিন্তাভাবনা। ২০১৫ সালে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ খাদি উৎসবের আয়োজন করে। এ উৎসবে দেশ বিদেশের ডিজাইনাররা অংশ নিয়েছিলেন৷ সকল ডিজাইনার আধুনিক ফ্যাশন ও খাদির অসাধারণ সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করেছেন প্রতিটি পোশাক। প্রতিটি পোশাকেই ফুটে উঠেছে ঐতিহ্যের ছাপ। নকশাবিদদের গবেষণা এবং উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের করে দেশেই তৈরি হচ্ছে শীত ও গরমে পড়ার উপযোগী খাদি। এছাড়াও, অতীতে চরকায় যে খাদি তৈরি হতো তা কিছুটা মোটা হতো, কিন্তু এখন ১৫০ কাউন্টের সুতা দিয়ে খাদি কাপড় বোনা হয় যা নিখুঁত, টেকসই ও আর্কষণীয় হয়। এখনকার সুতি খাদির পোশাক বেশ আরামদায়ক।
চিত্র- ২০১৫ সালে ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ এর আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় খাদি উৎসব ।
আধুনিক ফ্যাশনে কাঁথা এমব্রয়ডারির প্রভাব
আগের দিনে নকশিকাঁথা বলতে কাঁথাই হতো। গ্রামের ধারা অনুযায়ী নিজেদের জন্যই বানানো হতো। সেটার ফোঁড় ছিল টানা টানা। কিছু কিছু বিশেষ কাঁথা নারীরা বানাতেন, সেটা হলো বালিশ কাঁথা। তাঁদের মনের ভাবমূর্তি প্রকাশ পেতো কাঁথার ফোঁড়গুলোতে। গ্রামীণ জীবনের সুখ–কান্না, ভালোবাসা সব আবেগই তুলে ধরে নকশিকাঁথার মাধ্যমে। এছাড়াও বিভিন্ন রঙের শৈল্পিক নকশার কাঁথা ও বেশ জনপ্রিয় যা সেজুনি কাঁথা নামে পরিচিত। গ্রামীণ নারীদের ধৈর্য, নিপুণ বুননরীতি এবং এ কাজটির প্রতি ভালোবাসা থেকেই তৈরি হয় একেকটি কাঁথা। এই ঐতিহ্যবাহী নকশিকাঁথার নকশা বা ফোঁড় নতুন রূপে এখন চলে এসেছে নানা পোশাক, বিছানার চাদর, দেয়ালের ছবি, বালিশের কভার, মানিব্যাগ, বটুয়া ইত্যাদি জিনিসে। কাঁথার নকশা পরিপূর্ণ দেশীয় আমেজে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে সুতি, খাদি ও সিল্কের শাড়ি, কামিজ, ছেলেদের পাঞ্জাবি ওপর জমকালোভাবে। গয়নার ওপরও দেখা যাচ্ছে।
এছাড়াও, শীতের চাদর বা ট্রেঞ্চ কোটেও দেখা যাচ্ছে কাঁথা নকশার নিপুণ কাজ। শত বছরের পুরোনো এই সূচিকর্ম বেশ আধুনিকভাবেই উপস্থাপিত হয়েছে হালের ফ্যাশন দুনিয়ায়।
খাদিতে কাঁথার নকশা
নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে জমে ওঠে দেশীয় পোশাকের বাজার। দেশীয় কাপড় নিয়ে কাজ করছেন এমন কয়েকজন নকশাবিদ কাজ করতে শুরু করলেন খাদি নিয়ে৷ এ ফ্যাশন ট্রেন্ডটি ডিজাইনিং এর সময় ডিজাইনারদের মাথায় রাখতে হয়েছে এটি পরিবেশবান্ধব, স্থায়িত্ব হবে কিনা এবং নৈতিকতা মেনে ভোক্তাদের চাহিদা পূরণ করতে পারবে কিনা। এছাড়াও, ডিজাইনারা এ ডিজাইনিং প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন করেছেন, যেমনঃ Mind mapping, mood board, style board, color board, fabric swatch board, accessories board এবংrendered flat sketch। এ প্রক্রিয়া গুলোর মধ্য দিয়ে খাদির জমিনে কাঁথার নকশায় আনা হচ্ছে নতুনত্ব।
বিশ্ব বাজারে খাদির পরিচিতকরন এবং এর ভবিষ্যৎ
২০০৪ সালে, প্রসিদ্ধ ফ্যাশন হাউজ “ কে – ক্রাফট “ এর উদ্যোগে খাদি উৎসব অনুষ্ঠিত হয় যেখান দেশি বিদেশি অনেক ফ্যাশন ডিজাইনাররা অংশগ্রহন করেন। কিন্ত, বিভিন্ন কারনে তারা নিয়মিতভাবে এ উৎসবটি আর আয়োজন করতে পারেনি। পরবর্তীতে, ২০১৫ সালে মাহিন খান বাংলাদেশ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বিখ্যাত খাদির ঐতিহ্যকে ধরে রাখতে আানুষ্ঠানিকভাবে খাদি উৎসবের আয়োজন করে। যার স্লোগান ছিলো –“Go khadi”। এ উৎসব দেশি-বিদেশি ডিজাইনারদের মধ্য তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। মাহিন খানের মতে – নতুন আঙ্গিকে পরিবেশবান্ধব খাদিকে জনপ্রিয় করে তোলাই তাদের আয়োজনের উদ্দেশ্য তারই সাথে নতুন প্রজন্মের কাছে সচেতন ফ্যাশন শিল্প গড়ে তুলতে খাদি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
খাদিকে বলা হয় “ফিউচার ফেব্রিক“। খাদির বস্ত্রগুণ এমন যে, তা বায়োডিগ্রেডেবল, পরিবেশবান্ধব, টেঁকসই এবং একই সঙ্গে খাদির রয়েছে নিজস্ব স্টাইল। সহজে ধুয়ে শুকিয়ে নিয়ে একাধিক বার ব্যবহার করা যায় এবং শীত ও গ্রীষ্মকালে পড়ার উপযোগী। খুব শীঘ্রই আগামী দিনে এর চাহিদা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
তথ্যসূত্র : Wikipedia, ResearchGate, Culture Trip
লিখেছেনঃ আয়েশা জুলকারনাইন ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট, বুনন